ফিলিস্তিন সমস্যার আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট, ইতিহাস যাচাই ও ভবিষ্যৎ কুরআন হাদীস

You are currently viewing ফিলিস্তিন সমস্যার আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট, ইতিহাস যাচাই ও ভবিষ্যৎ কুরআন হাদীস

***ইসলামপূর্ব আরব সমাজে পবিত্র মক্কা নগরীর অনন্য বৈশিষ্ট্যঃ
ইসলাম আগমনের আগে আরবঃ

উপদ্বীপে কেন্দ্রীয় কোনো শাসন ছিল না। তবে ছোট ছোট আঞ্চলিক বেশ কয়েকটি রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এর উত্তর ও দক্ষিণ প্রান্তে। তবে আরব উপদ্বীপের মূল কেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত হিজাজ ছিল সব ধরনের রাজনৈতিক কাঠামো, রাজনৈতিক প্রভাব ও আধিপত্যের বাইরে। রাজনৈতিক কাঠামোর বিচারে ইসলামপূর্ব আরবকে তিনটি প্রধান অঞ্চলে বিভক্ত করা যায় : আরব উপদ্বীপের উত্তরাংশ, আরব উপদ্বীপের দক্ষিণাংশহিজাজ

ইসলামপূর্ব যুগে উল্লিখিত তিন অঞ্চলের রাজনৈতিক কাঠামো ও প্রকৃতি কেমন ছিল তা এখানে তুলে ধরা হলো।
দক্ষিণ আরবের রাজনৈতিক কাঠামো

আরব উপদ্বীপের দক্ষিণাংশে সুপ্রাচীন কাল থেকে কয়েকটি রাজ্য ছিল, যেগুলোর বেশির ভাগ খ্রিস্টপূর্ব যুগে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। তবে এসব রাজ্য সম্পর্কে খুব বেশি ঐতিহাসিক দলিল-প্রমাণ পাওয়া যায় না। তা থেকে ধারণা করা হয়, রাজ্যগুলো রাজনৈতিকভাবে স্থিতিশীল ছিল না।

ইসলামপূর্ব যুগে আরব উপদ্বীপের দক্ষিণাংশে গড়ে ওঠা কয়েকটি রাজ্যের বিবরণ নিম্নরূপ :

১. মুয়াইয়িন রাজ্য : খ্রিস্টপূর্ব ১২০০ থেকে ৬৩০ সাল পর্যন্ত তারা ইয়েমেনের উত্তরাঞ্চল শাসন করে। তবে এটা ছিল একটি আশ্রিত রাজ্য। বড় রাষ্ট্রের ছায়ায় দেশ পরিচালনা করত। কখনোই তারা স্বাধীন ছিল না।

রাজ্যটি কখনো একক নেতৃত্বে পরিচালিত হয়েছে আবার কখনো অভিজাত পরিষদের মাধ্যমে পরিচালিত হয়েছে।
২. সাবা রাজ্য : আরব অঞ্চলের প্রভাবশালী রাষ্ট্র ছিল সাবা। ইয়েমেনের দক্ষিণাঞ্চলে এই রাষ্ট্রের গোড়াপত্তন হয়। পরে মুয়াইয়িন রাজ্যসহ আঞ্চলিক রাজ্যগুলোকে অধীন করতে সক্ষম হয়। খ্রিস্টপূর্ব ৯৫০ থেকে ১১৫ সাল পর্যন্ত সাবা রাজ্য টিকে ছিল।

পবিত্র কোরআনের সুরা সাবা ও নামলে এই রাষ্ট্রের আলোচনা এসেছে। কোরআনের আলোচনা থেকে বোঝা যায় রাষ্ট্রটি রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ ছিল।

৩. হামির রাজ্য : ইয়েমেনের সাবা অঞ্চল এবং লোহিত সাগরের মধ্যবর্তী অঞ্চলে হামির রাজ্য গড়ে উঠেছিল, যা খ্রিস্টপূর্ব ১১৫ থেকে ৬৪০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত টিকে ছিল। রাজ্যটি সাবা ও রাইদান অঞ্চলকে জয় করে এবং পারস্য ও হাবশার সম্রাটের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হয়।

উত্তর আরবের রাজনৈতিক কাঠামোঃ

আরব উপদ্বীপের উত্তরাংশেও কয়েকটি ছোট রাজ্য গড়ে উঠেছিল। যেমন :

১. মানাজিরা রাজ্য : ইয়েমেন থেকে লাখমসহ কয়েকটি গোত্র আরব উপদ্বীপের উত্তরাংশে এসে বসতি স্থাপন করে। তারা সেখানে একটি রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে। হিরা নগরী ছিল তাদের রাজধানী। রাজ্যটি পারস্য সম্রাটের অধীন ছিল। খ্রিস্টীয় তৃতীয় শতকে মানাজিরা রাজ্যের যাত্রা শুরু হয় এবং ইসলাম আগমনের আগ পর্যন্ত তা টিকে ছিল। আরব রাজ্যগুলোর মধ্যে তারাই ছিল সবচেয়ে শিক্ষিত ও সভ্য। প্রাচীন আরবে মানাজিরদের প্রভাব ছিল সবচেয়ে প্রবল।

২. গাসসানিয়া রাজ্য : ইয়েমেন থেকে কয়েকটি গোত্র হিজরত করে উত্তর-পশ্চিম আরব তথা জর্দান ও দক্ষিণ সিরিয়ায় বসতি স্থাপন করে। তারা গাসসানিয়া নামে একটি রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে। গাসসানি শাসকরা রোমান শাসকদের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে রাজ্য পরিচালনা করত। গাসসানিদের রাজ্যে আরব-রোমান সংস্কৃতির মিশ্রণে নতুন সংস্কৃতির বিকাশ ঘটে।


হিজাজের রাজনৈতিক কাঠামোঃ

ভৌগোলিক অবস্থান, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের কারণে আরবের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল ছিল হিজাজ। পবিত্র কাবাসহ আরবের প্রসিদ্ধ কয়েকটি বাণিজ্যকেন্দ্র হিজাজে অবস্থিত ছিল। এ ছাড়া এখানে প্রভাবশালী কয়েকটি আরব গোত্র বাস করত। হিজাজে প্রচলিত কোনো রাষ্ট্রীয় ও রাজনৈতিক কাঠামো ছিল না। কোনো বিচারব্যবস্থা বা আইনি কাঠামোও সেখানে ছিল না। কোনো বহিরাগত শক্তি, রাষ্ট্র বা সেনাবাহিনী হিজাজ কখনো পদানত করতে পারেনি। তবে সেখানে প্রভাবশালী কিছু ব্যক্তির জন্ম হয়, যাঁরা আপন আপন গোত্রের অধিপতি ছিলেন।

ব্যতিক্রম মক্কাঃ

সমগ্র হিজাজে কোনো সুসংহত রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান না থাকলেও ব্যতিক্রম ছিল পবিত্র মক্কা নগরী। কেননা পুণ্যার্থীদের সেবা ও কাবাঘরের ব্যবস্থাপনা সুন্দর করতে এখানে একটি প্রশাসনিক কাঠামো গড়ে ওঠে। এই কাঠামো বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব সম্পাদন করত। যেমন :

১. হিজাবা : এর অধীনে ছিল কাবাঘর পাহারা দেওয়া এবং রক্ষণাবেক্ষণ করা। দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি ছাড়া অন্য কেউ কাবাঘরের দরজা খুলতে পারত না।


২. সিকায়া : এর অধীনে ছিল হাজিদেরকে জমজমের পানি পান করানো। জমজমের পানির সঙ্গে তাদেরকে খেজুর ও কিশমিশও দেওয়া হতো। ইসলামের প্রাথমিক যুগে এই দায়িত্ব আব্বাস (রা.) ও তাঁর সন্তানরা পালন করতেন।

৩. রিফাদা : রিফাদা হলো আপ্যায়ন। কুসাই বিন কিলাবের সময় থেকে কুরাইশ গোত্র হজের সময় হাজিদের আপ্যায়নে খাবারের ব্যবস্থা করত। কুরাইশের নির্ধারিত শাখা এই দায়িত্ব পালন করত।

গোত্রীয় শাসনের কাঠামোঃ

কেন্দ্রীয় শাসন না থাকলেও হিজাজে গোত্রীয় শাসন বিদ্যমান ছিল। গোত্রীয় শাসনকাঠামোতে প্রতিটি গোত্র, তার শাখা-উপশাখা ও পরিবারকে একটি জনগোষ্ঠী হিসেবে বিবেচনা করা হতো। একজন গোত্রপ্রধান এবং গোত্রীয় নেতাদের সম্মিলিত নেতৃত্বে তারা পরিচালিত হতো। গোত্রের শাখা বড় হয়ে গেলে তার স্বতন্ত্র গোত্র হিসেবে নিজস্ব কাঠামোতে পরিচালিত হতো।

প্রতিটি গোত্র নিজস্ব নিয়ম-নীতি ও অনুশাসন মেনে চলত। তারা জীবিকা নির্বাহ ও সামাজিক কল্যাণে পরস্পরকে সহযোগিতা করত। বিশেষত শত্রুর মোকাবেলা এবং বন্ধুর সহযোগিতা সম্মিলিতভাবে সম্পন্ন করত। নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হিজাজের গোত্রগুলো পরস্পরের সঙ্গে হালাফ বা বন্ধু চুক্তিতে আবদ্ধ হতো। প্রতিটি গোত্র তার বন্ধু গোত্রের নিরাপত্তা ও রক্তের দায় গ্রহণ করত।(আন-নিজামুস সিয়াসি ফিল ইসলাম)

হজরত মুসা আ. স্বৈরাচারী ফেরাউনের কবল থেকে মুক্ত হওয়ার পর শাম অঞ্চলেই হিজরত করেছিলেন। মূলত শাম বলে সেকালে ফিলিস্তিন, সিরিয়া, লেবানন, জর্ডান ও আশপাশের অঞ্চলকে বোঝানো হতো। 

মুসা (আ.)-এর যুগে বনী ইসরাইলকে ফিলিস্তিনে প্রবেশের আদেশ দেওয়া হয়েছিল। মুসা (আ.) তাদের বলেছিলেন, ‘হে আমার সম্প্রদায়, পবিত্র ভূমিতে প্রবেশ করো, যা আল্লাহ তোমাদের জন্য নির্ধারিত করে দিয়েছেন এবং তোমরা পৃষ্ঠ প্রদর্শন কোরো না। অন্যথায় তোমরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে।’ (সুরা মায়িদা: ২১) অবশ্য বনি ইসরাইলরা তখন এ আদেশ অমান্য করে এবং মুসা (আ.)-কে বলে, ‘আপনি ও আপনার রব যুদ্ধ করুন; আমরা এখানে বসে থাকব।’

আল্লাহর নবী হজরত ইবরাহিম ও লুত (আ.)-কে আল্লাহ তায়ালা ফিলিস্তিনে হিজরতের কথা বলেছিলেন। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আমি তাকে ও লুতকে উদ্ধার করে সে দেশে পৌঁছিয়ে দিলাম, যেখানে আমি বিশ্বের জন্য অফুরন্ত কল্যাণ রেখেছি।’ (সুরা আম্বিয়া: ৭১)

পবিত্র কোরআনের একাধিক আয়াতে আল্লাহ তায়ালা একটি অঞ্চলকে পবিত্র ও বরকতময় আখ্যা দিয়েছেন। সরাসরি শাম শব্দ পবিত্র কোরআনে আসেনি, তবে একাধিক আয়াতে আল্লাহ তায়ালা যে ভূমিকে বরকতময় ও পবিত্র বলেছেন, তাতে ফিলিস্তিনসহ পুরো অঞ্চলটি অন্তর্ভুক্ত বলে জানিয়েছেন তাফসিরকারগণ।

সূরা বনী ইসরাঈলের প্রথম আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বরকতময় ভূমি বলে এই অঞ্চলের দিকে ঈঙ্গিত করেছেন। বর্ণিত হয়েছে— পবিত্র মহান সে সত্তা, যিনি তাঁর বান্দাকে রাতে নিয়ে গিয়েছেন আল মাসজিদুল হারাম থেকে আল মাসজিদুল আকসা* পর্যন্ত, যার আশপাশে আমি বরকত দিয়েছি, যেন আমি তাকে আমার কিছু নিদর্শন দেখাতে পারি। তিনিই সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা।

অন্য আয়াতে হজরত সোলায়মান (আ.)-এর ঘটনায়ও ফিলিস্তিনকে বরকতময় ভূমি বলা হয়েছে। কোরআনে এরশাদ হয়েছে, ‘আমি প্রবল বায়ুকে সোলায়মানের অধীনে করে দিয়েছিলাম; তা তার আদেশে প্রবাহিত হতো ওই দেশের দিকে, যেখানে আমি বরকত দান করেছি।’ (সুরা আম্বিয়া: ৮১)

মদিনার মসজিদে নববী

মদিনা তার তুলনামূলকভাবে সংক্ষিপ্ত অস্তিত্বের মধ্যে অনেকগুলো ক্ষমতার অধীনে ছিল। অঞ্চলটি ইহুদি-আরবীয় উপজাতিদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়েছে (৫ম খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত), আউস ও খাযরাজ (মুহাম্মদের আগমন পর্যন্ত), মুহাম্মাদ এবং রাশিদুন (৬২২-৬৬০ খ্রিস্টাব্দ), উমাইয়া (৬৬০-৭৪৯ খ্রিষ্টাব্দ), আব্বাসীয় (৭৪৯-১২৫৪ খ্রিস্টাব্দ), মিশরের মামলুক (১২৫৪-১৫১৭ খ্রিস্টাব্দ), উসমানীয় (১৫১৭–১৮০৫ খ্রিস্টাব্দ), প্রথম সৌদি রাষ্ট্র (১৮০৫-১৮১১ খ্রিস্টাব্দ), মুহাম্মদ আলি পাশা (১৮১১–১৮৪০ খ্রিস্টাব্দ), দ্বিতীয়বারের জন্য উসমানীয়রা (১৮৪০-১৯১৮), হাশিমদের অধীনে মক্কা শরিফাত (১৯১৮-১৯২৫ খ্রিস্টাব্দ) এবং অবশেষে বর্তমান সৌদি আরব সাম্রাজ্যের হাতে (১৯২৫-বর্তমান খ্রিস্টাব্দ)।

জেরুজালেমের আল আক্বসা

প্রাচীনকালে বনী ইসরাঈলের লোকেরাও হুবহু এভাবে ঘুরে ঘুরে জেরুজালেম তাওয়াফ করত বলে ইহুদী পণ্ডিতগণ জানিয়েছেন।

ইসলাম পূর্ববর্তী যুগে আল আকসাঃ

আল আকসা পৃথিবীতে নির্মিত দ্বিতীয় মসজিদ। মক্কায় মসজিদুল হারাম নির্মাণের ৪০ বছর পরে এই মসজিদ নির্মাণ করা হয়। প্রথম কে আল আকসা নির্মাণ করেন তা নিশ্চিত করে জানা না গেলেও এ ব্যাপারে ঐতিহাসিকদের তিনটি মত পাওয়া যায়।

কেউ বলেন, এই মসজিদের প্রথম নির্মাতা হলেন আদিপিতা হজরত আদম আলাইহিস সালাম। কেউ বলেন, নুহ আলাইহিস সালোমের সন্তান সাম এই মসজিদের আদি নির্মাতা। আবার কারো মতে, হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালাম প্রথম এই মসজিদের ভিত্তি নির্মাণ করেন।

নবীদের যুগে আল আকসাঃ

আধুনিক গবেষকরা হজরত আদম আলাইহিস সালামকে এই মসজিদের প্রথম নির্মাতা বলে মতামত দিয়েছেন। নূহ আলাইহিস সালামের মহাপ্লাবনে ধ্বংস হওয়ার পরে হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালাম এর পুনঃনির্মাণ করেন। পরবর্তীতে তার বংশধররা এই মসজিদের পরিচর্যার দায়িত্ব পালন করেন। কালের পরিক্রমায় হজরত মুসা আলাইহিস সালামেরসহ অনেক নবী এই মসজিদের সংস্কার কাজ কাজ করেন। হজরত দাউদ ও সুলাইমান আলাইহিস সালামের সময় পর্যন্ত অনেক সংযোজনের মধ্য দিয়ে মসজিদুল আকসা বিস্তৃত কম্পাউন্ডে রূপান্তরিত হয়।

১ম বিশ্বযুদ্ধের ফলাফলঃ ভূমধ্যসাগর পূর্বে ২৮,৪২৯ বর্গমাইলব্যাপী ফিলিস্তিন দেশটি ছিল অটোম্যান সাম্রাজ্যের বা উসমানীয় খিলাফতের অধীন, প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যারা ছিল ব্রিটিশ-বিরোধী জোটে৷ তখন যুদ্ধ জয়ে ফিলিস্তিনদের সহযোগিতা পাওয়ার আশায় ১৯১৭ সালে ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী লর্ড বেলফোর যুদ্ধে জয়ী হলে এই ভূমিতে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হবে বলে আশ্বাস দেন৷ যা ইতিহাসে “বেলফোর ঘোষণা” হিসেবে পরিচিত৷ যেহেতু ফিলিস্তিন অঞ্চলে আরবীয় ছিল ইহুদীদের তুলনায় কয়েকগুণ বেশি, সেহেতু ঘোষণাটি তাদের অনুকূল বলেই ধরে নেয় স্থানীয় আরবীয়রা।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটেনের প্রয়োজনে দুর্লভ বোমা তৈরির উপকরণ কৃত্রিম ফসফরাস তৈরি করতে সক্ষম হন ইহুদি বিজ্ঞানী ড. হেইস বাইজম্যান৷ ফলে আনন্দিত ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী জানতে চাইলেন কী ধরনের পুরস্কার তিনি চান? উত্তর ছিল- “অর্থ নয়, আমার স্বজাতির জন্য এক টুকরো ভূমি আর তা হবে ফিলিস্তিন৷  ফলে ফিলিস্তিন ভূখণ্ডটি ইহুদীদের হাতে তুলে দেয়ার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুতি নেয় ব্রিটেন৷ প্রথম বিশ্বযুদ্ধ জয়ের পর ব্রিটেন স্বাধীনতা দেয়ার অঙ্গীকারে ১৯১৮ সাল থেকে ৩০ বছর দেশটিকে নিজেদের অধীন রাখে৷ মূলত এই সময়টিই ফিলিস্তিনকে আরব-শূন্য (বিশেষত মুসলিম-শূন্য) করার জন্য কাজে লাগায় ইঙ্গ-মার্কিন শক্তি৷

ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদকরণঃ

১৯২০ সালে জাতিপূন্জের ঘোষণার মাধ্যমে ব্রিটিশরা ম্যান্ডেটরী প্যালেস্টাইন  প্রতিষ্ঠা করে। ব্রিটিশ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার পর বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে দলে দলে ইহুদীরা ফিলিস্তিনে জড়ো হতে থাকে, যাকে আলিয়াহ বলা হয়। অতঃপর ব্রিটিশ সরকার একদিকে ইহুদিদের জন্য ফিলিস্তিন উন্মুক্ত করে দেয়, অন্যদিকে ব্রিটিশ বাহিনীর সহযোগিতায় ইহুদি মিলিশিয়ারা (আধা-সামরিক বাহিনী সদৃশ) ফিলিস্তিনদের বিতাড়িত করে নিজেদের অবস্থান সুদৃঢ় করার জন্য গড়ে তুলতে থাকে৷ তার মধ্যে তিনটি প্রধান সংগঠন ছিল হাগানাহ, ইরগুন ও স্ট্যার্ন গ্যাং যারা নৃতাত্ত্বিক হত্যা(Ethnic Cleansing), সন্ত্রাস, ধর্ষণ আর ধ্বংসযজ্ঞ সৃষ্টির মাধ্যমে ফিলিস্তিনদের বাধ্য করে ফিলিস্তিন ছেড়ে চলে যেতে৷

২য় বিশ্বযুদ্ধের ফলাফলঃ

সংগঠনগুলোর গণহত্যার কথা যখন আন্তর্জাতিকভাবে প্রচারিত হচ্ছিল তখন পরিস্থিতকে নিজেদের অনুকূলে আনার জন্য গুপ্ত সংগঠন হাগানাহ বেছে নেয় আত্মহনন পন্থা৷ ১৯৪০ সালে এসএস প্যাট্রিয়া নামক একটি জাহাজকে হাইফা সমুদ্র বন্দর তারা উড়িয়ে দিয়ে ২৭৬ জন ইহুদিকে হত্যা করে৷ ১৯৪২ সালে আরেকটি জাহাজকে উড়িয়ে দিয়ে ৭৬৯ জন ইহুদিকে হত্যা করে৷ (হিটলার এর নাজী সেনারাও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্যাপক ইহুদীদের হত্যাযজ্ঞ চালায়।)

উভয় জাহাজে করে ইহুদিরা ফিলিস্তিনে আসছিল আর ব্রিটিশরা সামরিক কৌশলগত কারণে জাহাজ দুটিকে ফিলিস্তিনের বন্দরে ভিড়তে দিচ্ছিল না৷ হাগানাহ এভাবে ইহুদিদের হত্যা করে বিশ্ব জনমতকে নিজেদের পক্ষে আনার চেষ্টা করে৷ পাশাপাশি ইহুদিদের বসতি স্থাপন ও আরবদের উচ্ছেদকরণ চলতে থাকে খুব দ্রুত৷ এর ফলে ২০ লাখ বসতির মধ্যে বহিরাগত ইহুদির সংখ্যা বেড়ে দাড়ায় ৫ লাখ ৪০ হাজার৷ এ সময়ই ১৯৪৭ সালের ২৯ নভেম্বর ইয়াহুদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ইঙ্গ-মার্কিন চাপে জাতিসংঘে ভোট গ্রহণ করা হয়, তাতে ৩৩টি রাস্ট্র ফিলিস্তিনে ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পক্ষে, ১৩টি বিপক্ষে এবং ১০টি ভোট প্রদানে বিরত থাকে৷ প্রস্তাব অনুযায়ী মোট জনসংখ্যার এক-চতুর্থাংশ হয়েও ইহুদিরা পেল ভূমির ৫৭% আর ফিলিস্তিনীরা পেল ৪৩% তবে প্রস্তাবিত ইয়াহুদী রাষ্ট্রটির উত্তর-পশ্চিম তীর রামাল্লায় সীমানা ছিল অনির্ধারিত ফলে ভবিষ্যৎ ইহুদিরা সীমানা বাড়াতে পারে৷ এভাবে ইহুদিদের কাঙ্ক্ষিত ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা নিশ্চিত হয়ে পড়ে।

ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাঃ

ফিলিস্তিন অঞ্চলের কার্যত মালিকানা লাভের পর ইহুদি বসতি বাড়ানোর লক্ষ্যে এবং ফিলিস্তিনদের উচ্ছেদ করার উদ্দেশে রাতে তাদের ফোন লাইন, বিদ্যুৎ লাইন কাটা, বাড়িঘরে হ্যান্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ, জোর করে জমি দখল এবং বিভিন্নভাবে নারী নির্যাতনের মতো কাজে জড়িয়ে পড়লো স্থানীয় ও বহিরাগত ইহুদি ও সরকারের মদদপুষ্ট সেনাবাহিনী৷ ফলে লাখ লাখ ফিলিস্তিনিরা আরব দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হয়।

এরপরই ১৯৪৮ সালের ১২মে রাত ১২টা এক মিনিটে ইসরায়েল রাষ্ট্র ঘোষণা করে ইহুদি জায়নবাদী, যাদের প্রধান ছিলেন ডেভিড বেন গুরিয়ন(পরবর্তীতে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী)৷ ১০ মিনিটের ভেতর যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়, অতঃপর সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ব্রিটেন স্বীকৃতি দেয়।

মুসলমানরা যেভাবে আল আকসার নিয়ন্ত্রণ হারায়

১৯৬৭ সালের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধে পরাজয়ের মধ্য দিয়ে আল আকসার নিয়ন্ত্রণ হারায় মুসলমানরা। এর আগে এটি জর্ডানের শসকদের কর্তৃত্বাধীন ছিল। বর্তমানে আকসা কমপ্লেক্স ইসরায়েলের নিয়ন্ত্রণে থাকলেও মসজিদ পরিচালিত হয় জর্ডান-ফিলিস্তিনের একটি ওয়াকফ প্রতিষ্ঠানের তত্ত্বাবধানে। যদিও এর প্রবেশপথগুলোতে মোতায়েন করা থাকে ইহুদি দখলদার সেনারা। তারা অনেক তল্লাশির পরে মুসল্লিদেরকে মসজিদে আকসায় প্রবেশ করতে দেয়। 

আল আকসা নির্মাণের ইতিহাস 

নির্মাণ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং রাজনৈতিক কারণে কয়েক দফা ধ্বংস এবং পুনঃনির্মাণের মধ্য দিয়ে গড়ে উঠেছে বর্তমানের আল আকসা কমপ্লেক্স। তাই আল আকসার নির্মাণ ইতিহাস দুই পর্বে আলোচনা করা হয়। ইসলাম পূর্ব যুগ। ইসলাম পরবর্তী যুগ। 

আল আকসায় যত ধ্বংসযজ্ঞ

সুলাইমান আলাইহিস সালাম আকসা চত্বরে একটি আলীশান ভবন নির্মাণ করেন। যেটিকে হায়কালি সুলাইমানি বলা হতো। পরবর্তী সময়ে ধর্ম বিকৃতকারী ইহুদিরা এটিকে তাদের মন্দির হিসেবে গ্রহণ করে। তারা এটির নাম দেয় সলেমন ট্যাম্পল। 

খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দী ব্যবিলনের বাদশাহ বুখতে নাসর এই কম্পাউন্ডে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। হায়কালে সুলাইমানিকে সে গুড়িয়ে দেয়। নবীদের স্মৃতিস্মারকগুলোকে লুট করে নিয়ে যায়। 

এ ঘটনার ৭০ বছর পর খ্রিস্টপূর্ব ৩৮০ সালে তৎকালীন ইরানের সম্রাট বাবেল শহর জয় করেন। তার আনুকূল্যে ইহুদিরা আবারও বায়তুল মুকাদ্দাসের দখল নেয়। আবারও তারা ‘সলেমন ট্যাম্পল’ পুননির্মাণ করে। এটিকে তারা সেকেন্ড ট্যাম্পল নাম দেয়। 

খৃস্টানদের দখলে আল আকসা

৯৮ বছর পরে গ্রিক সম্রাট অ্যারোটেনিস গোটা ফিলিস্তিন দখল করে সলেমন ট্যাম্পলকে গ্রীক উপাসনালয়ে পরিণত করে। পরবর্তী সময়ে ৩১২ খ্রিস্টাব্দে রোম সম্রাট কনস্টান্টিনোপল খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত হলে জেরুসালেমে খ্রিস্টানদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। তাদের বিশ্বাস অনুযায়ী আল আকসা কমেপ্লেক্সেই ‘যিশুকে ক্রুশবিদ্ধ করা হয়েছিল’। ফলে এখানে তারা একটি গির্জা প্রতিষ্ঠা করে। 

এসময় বহু নবী এবং আল্লাহর প্রতিনিধিকে হত্যাকারী ইহুদি সম্প্রদায় ভূমিহীন এবং আশ্রয়হীন হয়ে পড়ে। কোরআনে ঘোষিত ইহুদি জাতির প্রতি লাঞ্চনার প্রতীক হিসেবে আধুনিক ইসরায়েল প্রতীষ্ঠার আগ পর্যন্ত তারা ভূমিহীন থাকে।  

ইসলাম পরবর্তী যুগ

মেরাজের রাতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালামের আল আকসায় আগমনের মধ্য দিয়ে ইসলামি যুগের সূচনা হয়। হিজরী ১৪ সালে খলীফা ওমর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু ফিলিস্তিন বিজয়ের পরে প্রথমে এখানে মসজিদে ওমর নির্মাণ করেন। এরপর ৭২ হিজরি মোতাবেক খ্রিস্টিয় ৬৯১ সালে উমাইয়া খলিফা আবদুল মালিক বিন মারওয়ান সেখানে নির্মাণ করেন অষ্টকোণাকৃতির ঐতিহাসিক কুব্বাতুস সাখরা বা সোনালী গম্ভুজ। এর ভিতরে একটি পাথর আছে, এই পাথরকে কেন্দ্র করে এই গম্ভুজ নির্মাণ করা হয়েছে। ইহুদি বিশ্বাস মতে এটি পৃথিবীর ফাউন্ডেশন স্টোন। 

কুব্বাতুস সাখরায় ইসলামি স্থাপত্যের প্রাচীন নমুনার নকশা মেলে। অষ্টকোণাকৃতির বেজমেন্ট থেকে কথিত স্বর্ণ খচিত গম্ভুজের উচ্চতা বিশ মিটার। ফিরোজা রঙয়ের টাইলসে অঙ্কিত হয়েছে বিভিন্ন ধরনের শৈল্পিক কারুকাজ। গম্ভুজের দেয়ালের শোভা বর্ধন করেছে সূরা ইয়াসিনের লিখিত আয়াতগুলো। 

বিভিন্ন মুসলিম শাসনামলে আল আকসা

কুব্বাতুস সাখরা ছাড়াও আল আকসা কমপ্লেক্সে ছোট বড় আরও কয়েকটি মসজিদ নির্মিত হয়েছে পরবর্তী মুসলিম শাসনামলে। তার মধ্যে অন্যতম হলো, কিবলি মসজিদ, মারওয়ানি মসজিদ, বেরাক মসজিদ। এই মসজিদগুলোর বিভিন্ন মেহরাব, মিম্বার ইত্যাদির সমন্বিত পরিচয় আল আকসা।

উমাইয়া ও আব্বসীয় শাসনামলে আল আকসা

উমাইয়া খেলাফতকালে ইসলামের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এই স্থাপনার প্রতি বিশেষ মনোযোগ দেওয়া হয়। উমাইয়া শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতায় আল আকসা ইসলামি শিক্ষা-সংস্কৃতির কেন্দ্রভূমিতে পরিণত হয়। বেশ কিছু মাদরাসা প্রতিষ্ঠিত হয় আল আকসা কমপ্লেক্সে। 

উমাইয়াদের পর আব্বাসীয় শাসকরাও আকসার পৃষ্ঠপোষকতা জারি রাখে। তাদের শাসনামলেও অনেক সংস্কার হয়। কিন্তু রাজধানী বাগদাদ থেকে আল আকসার অবস্থান দূরে হওয়ায় কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণে কিছু শিথিলতা আসে। এর সুযোগ নিয়ে কূচক্রি শিয়া ইসমাঈলিয়া গোষ্ঠী ফিলিস্তিন দখল করে নেয়। প্রায় একশত বছর আল আকসা তাদের শাসনাধীন ছিল। এসময় ভ্রান্ত শিয়া মতবাদ প্রচারের কেন্দ্রভূমিতে পরিণত করা হয় আল আকসাকে। 

পরবর্তীতে সেলজুক সুলতানরা আল আকসা পুনরুদ্ধার করেন। এসময় নতুন করে বিশুদ্ধ ইসলামি শিক্ষাধারার প্রচলন নতুন করে শুরু হয়। লোকশ্রুতি আছে, ইমাম গাজালি এসময় কিছুকাল আল আকসায় অবস্থান করেছিলেন।   

ক্রুডেসারদের ধ্বংসযজ্ঞের কবলে আল আকসা

এর কিছুদিন পরই ইসলাম ও মুসলমানদের ওপর নেমে আসে ভয়াবহ দুর্যোগ। ১০৯৯ খ্রিস্টাব্দে ক্রুসেডবাহিনী জেরুসালেমসহ সিরিয়া দখল করে নেয়। পবিত্র আল আকসা দখল করে ক্রুসেডাররা সেখানে গণহত্যা চালায়। মসজিদগুলোর কোনটিকে গির্জা, কোনটিকে আস্তাবলে পরিণত করে।

আল আকসায়  সালাহউদ্দীন আইয়ূবীর যুগ

প্রায় নব্বই বছর পর্যন্ত আল আকসা মুসলমানদের বেদখল থাকে। পরবর্তীতে আল্লাহ তায়ালা সুলতান গাজী সালাহুদ্দীন আইয়ূবীকে বায়তুল মোকাদ্দাস পুনরুদ্ধারের মহাসৌভাগ্য দান করেন। ১১৮৭ সালে আল আকসায় পুনরায় মুসলমানের নামাজ পড়ার তাওফিক হয়। 

এ সময় সুলতান সালাহুদ্দীন আইয়ুবী বিজয়ের স্মৃতিস্মারক হিসেবে আল আকসা কমপ্লেক্সে একটি মিম্বার নির্মাণ করেন। মামলুক সুলতানদের শাসনামলে এখানে আন্তর্জাতিক মানের একটি ইসলামি প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠে। আল আকসা আবারও ইসলামি জ্ঞান বিজ্ঞানের প্রাণকেন্দ্রে পরিণত হয়।  

উসমানীয় আমলে আল আকসা  

ষোল শতকের শুরুর দিকে আল আকসা উসমানীয় খলিফাদের নিয়ন্ত্রণে আসে। অটোমান শাসকরা মক্কা, মদিনায় অবস্থিত পবিত্র দুই মসজিদের  মতোই আল আকসার পরিচর্যা ও রক্ষণাবেক্ষণে বিশেষ তৎপর ছিলেন। আল আকসার প্রতি সুলতান সুলাইমান আল কানুনীর বিশেষ নির্দেশনা ছিল। শেষ স্বাধীন উসমানীয় সুলতান দ্বিতীয় আবদুল হামিদও ইহুদিদের নানামুখী কূট-ষড়যন্ত্র এবং প্রলোভনের মুখে আল আকসা রক্ষায় অত্যন্ত দৃঢ়চেতা ও অনমনীয় ছিলেন। 

সর্বশেষ উসমানীয় খেলাফত বিলুপ্তির পর আল আকসাবাসীর ভাগ্যে নেমে আসে নতুন দুর্যোগ। সে দুর্যোগ এখনও চলমান। এখন আল আকসায় দুই রাকাত নামাজ পড়তেও প্রয়োজন হয় ইহুদি সেনাদের ছাড়পত্র। 

প্রথম কিবলাঃ

আল-কুদস বলতে বোঝায় ফিলিস্তিনের জেরুজালেম পবিত্র ভূমিতে অবস্থিত পবিত্র মসজিদ। যা মসজিদুল আকসা বা ‘বায়তুল মুকাদ্দাস’ নামে পরিচিত। নবি ইবরাহীম কর্তৃক কাবাঘর নির্মাণের চল্লিশ বছর পর তার ছেলে ইসহাক এর সন্তান ইয়াকুব ফিলিস্তিনের জেরুজালেম নামক স্থানে ‘আল-আকসা’ মসজিদটি নির্মাণ করেন। অতঃপর তার ছেলে ইউসুফ এর বংশধর দাউদ এর সন্তান হজরত সুলাইমান তা সংস্কার করেন। তিনি রমজান মাসের শেষ শুক্রবার জেরুজালেম নগর প্রতিষ্ঠা করেন। প্রথমে ‘কাবা’ কিবলা থাকলেও মসজিদুল আকসা বা ‘বায়তুল মুকাদ্দাস’ স্থাপনের পর এটি কিবলা হিসেবে স্বীকৃতি পায়। এটি মুসলমানদের প্রথম ক্বিবলা।

কিবলা পরিবর্তনের আয়াতঃ

قَدْ نَرَىٰ تَقَلُّبَ وَجْهِكَ فِي السَّمَاءِ ۖ فَلَنُوَلِّيَنَّكَ قِبْلَةً تَرْضَاهَا ۚ فَوَلِّ وَجْهَكَ شَطْرَ الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ ۚ وَحَيْثُ مَا كُنتُمْ فَوَلُّوا وُجُوهَكُمْ شَطْرَهُ ۗ وَإِنَّ الَّذِينَ أُوتُوا الْكِتَابَ لَيَعْلَمُونَ أَنَّهُ الْحَقُّ مِن رَّبِّهِمْ ۗ وَمَا اللَّهُ بِغَافِلٍ عَمَّا يَعْمَلُونَ

অনুবাদ: ( হে নবী!) আমি তোমার চেহারাকে বারবার আকাশের দিকে উঠতে দেখছি। সুতরাং যে কিবলাকে তুমি পছন্দ কর আমি শীঘ্রই সে দিকে তোমাকে ফিরিয়ে দেব। সুতরাং এবার মসজিদুল হারামের দিকে নিজের চেহারা ফেরাও। এবং (ভবিষ্যতে) তোমরা যেখানেই থাক (সালাত আদায়কালে) নিজের চেহারা সে দিকেই ফেরাবে। যাদেরকে কিতাব দেওয়া হয়েছে, তারা জানে এটাই সত্য, যা তাদের প্রতিপালকের পক্ষ হতে এসেছে। আর তারা যা কিছু করছে আল্লাহ সে সম্বন্ধে উদাসীন নন।(সূরা বাকারা-১৪৪)

وَلَئِنْ أَتَيْتَ الَّذِينَ أُوْتُواْ الْكِتَابَ بِكُلِّ آيَةٍ مَّا تَبِعُواْ قِبْلَتَكَ وَمَا أَنتَ بِتَابِعٍ قِبْلَتَهُمْ وَمَا بَعْضُهُم بِتَابِعٍ قِبْلَةَ بَعْضٍ وَلَئِنِ اتَّبَعْتَ أَهْوَاءهُم مِّن بَعْدِ مَا جَاءكَ مِنَ الْعِلْمِ إِنَّكَ إِذَاً لَّمِنَ الظَّالِمِينَ

অনুবাদ: যাদেরকে কিতাব দেওয়া হয়েছিল তুমি যদি তাদের কাছে সব রকমের নিদর্শনও নিয়ে আস, তবুও তারা তোমার কিবলা অনুসরণ করবে না। তুমিও তাদের কিবলা অনুসরণ করার নও, আর তাদের পরস্পরেও একে অন্যের কিবলা অনুসরণ করার নয়। তোমার নিকট জ্ঞান আসার পরও যদি তুমি তাদের খেয়াল-খুশীর অনুসরণ কর, তবে তখন অবশ্যই জালিমদের মধ্যে গণ্য হবে। (সূরা বাকারা, আয়াত-১৪৫)

কিবলা পরিবর্তনের কারণঃ

ইসলামের প্রাথমিক যমানায় আল্লাহর আদেশে মসজিদে আকসার দিকে ফিরে নামাজ আদায় করতেন। কিন্তু মুহাম্মাদের ( সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ইচ্ছা ও আকাঙ্ক্ষা ছিল কাবার দিকে ফিরে নামায পড়া। তাই তিনি মক্কায় থাকাকালীন এমন সমান্তরালভাবে নামাজে দাড়াতেন যেন কাবা এবং মসজিদে আকসা সম্মুখে থাকে। কিন্তু মুসলমানরা যখন মদীনায় হিযরত করেন, তখন নামাজ পড়ার সময় কাবাকে আল-আকসার মাঝে রাখার সুযোগ আর ছিলোনা। কেননা, মদীনার অবস্থান ছিল মক্কা থেকে উত্তরে। মদীনারও উত্তরে অবস্থান জেরুসালেমের। ফলে নামাজ আদায়ের সময় মক্কার দিকে ঘুরে দাঁড়ানোর কোন সুযোগ মুহাম্মদের জন্য ছিলোনা। এছাড়াও কাবা পৃথিবীর ইতিহাসের প্রথম ঘর যা মানুষের দ্বারা বানানো হয়েছে।

মুহাম্মদ এই কারণে খুবই মনঃক্ষুণ্ন ছিলেন। তার সর্বদাই মনে হতো, তিনি ইবরাহীম কর্তৃক নির্মিত আল্লাহর প্রথম এই ঘরকে সম্মান জানাতে পারছেন না।

তার এই অনুভূতির জন্য তিনি অবশ্য কেবলা পরিবর্তনের জন্য আল্লাহর কাছে কোন প্রার্থনা করেন নি। তবে যখন মক্কার দিকে মুখ ফিরিয়ে নামাজ না পড়তে পারার কষ্ট কাজ করতো, তখন তিনি আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতেন। 

ফলে মদীনায় হিযরতের পরের বছরই আল্লাহ কেবলা পরিবর্তনের আদেশ দিয়ে মুহাম্মদের উপর আয়াত নাযিল করেন।

পবিত্র কুরআন মহান আল্লাহর বাণী। তাইতো এটি মানুষকে পবিত্র করে। এর মাঝে কোনো স্ববিরোধিতা নেই। যেভাবে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-‘এরা কি লক্ষ্য করে না কুরআনের প্রতি? আর এটা (কুরআন) যদি আল্লাহ ব্যতিত অন্য কারও পক্ষ থেকে নাজিল হত, তবে এতে অবশ্যই বহু বৈপরিত্য দেখতে পেত।’ (সুরা নিসা : আয়াত ৮২)

মজলুমের দোয়া আল্লাহ কবুল করে থাকেন_এটা আল্লাহতায়ালার ওয়াদা। আল্লাহ বলেছেন_’এ কারণেই আমি বনী ইসরাঈলের প্রতি লিখে দিয়েছি, যদি কেউ প্রাণের বিনিময়ে প্রাণ অথবা পৃথিবীতে অনর্থ সৃষ্টি করে কাউকে হত্যা করে, সে যেন সব মানুষকেই হত্যা করে। আর যে কারো জীবন রক্ষা করে, সে যেন সবার জীবন রক্ষা করে।’ (সুরা আল-মায়িদা, আয়াত-৩২)।

রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, কিয়ামতের দিন সর্বপ্রথম মানুষের মধ্যে হত্যা সম্বন্ধে বিচার করা হবে। (বুখারি-মুসলিম)।

বদর যুদ্ধের কারণঃ
মদিনায় হিজরতের আগে মক্কার নেতৃস্থানীয়দের বিরোধিতার মুখে পড়তে হয়েছিল মুসলমানদের। তবে, পরবর্তীতে মক্কা ও মদিনার মধ্যে যুদ্ধের নেপথ্যে এটাই একমাত্র কারণ নয়।

দ্বিতীয় হিজরি বর্ষের রজব মাসের ১১ তারিখে মক্কার একজন গোত্র প্রধান আমর বিন আল-হাদরামি দুর্ঘটনাবশত মুসলমানদের হাতে নিহত হন। ইসলামের নবী স্থানীয় ঐতিহ্য অনুসারে এই হত্যার জন্য ক্ষতিপূরণ পরিশোধ করেন।

কিন্তু মক্কায় কুরাইশদের প্রধানরা এই ঘটনায় ভীষণ ক্ষুব্ধ হয়।

সূত্রঃ উইকিপিডিয়া, ঢাকা পোস্ট, সায়েন্টিফিক তাফসির, রকমারি, আজাদি।

Leave a Reply